Search This Blog

টিউশন সমাচার



টিউশন সমাচার 




দেখতে দেখতে দেড় বছর হয়ে গেলো টিউশন করাচ্ছি। সময়ের হিসাবে খুব দীর্ঘ হয়তো না। কিন্তু এ কয়দিনে এতো এতো স্টুডেন্ট বা পরিবারের সান্নিধ্যে এসেছি এবং যে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি তা হয়তো একদমই ফেলনা নয়! বিশেষ করে আমার জীবনের বড় একটা অংশজুড়েই থাকবে এই অভিজ্ঞতাগুলো।
একে একে শুরু করি গল্প গুলো!  থার্ড সেমিস্টারে মিড শেষ হওয়ার পরপরই টিউশন শুরু করি আমি। স্টুডেন্ট ও আমি একই  বিল্ডিং এই থাকি!  তাকে পড়ানোর একমাত্র অসুবিধা ছিলো  ঝড়-বৃষ্টির সময়েও পড়াতে যাওয়া ( যেহেতু একই বিল্ডিং)!  এরপরের স্টুডেন্ট ছিল এডমিশন পরিক্ষার্থী। মূলত 
ওকে পড়ানোর পরপরই বলা যায় আমি তুমুল টিউশন করানো শুরু করি!  একটাসময় মাসে চারটা টিউশন টানা কয়েকমাস  পর্যন্ত করাই ! (ইভেন একমাসে একবার পাঁচটাও হয়ে যায়!)।  আমি নিজেও অবাক হয়ে যাই- IIT তে পড়ে ৯-৪ টা ক্লাস করে কিভাবে করলাম এতোকিছু! সেই দিনগুলা! বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ৯ টা বাজতো। আমার ভালোই লাগতো রাতে বাইরে হাঁটাহাঁটির ব্যাপারটা। আকাশে চাঁদ থাকতো। স্পেশালি গাছের পাতার ফাঁকে আকাশের চাঁদ দেখার সৌন্দর্য দেখে আমি নিমিষেই ভুলে যেতাম সারাদিনের তীব্র পরিশ্রমকে!
আমার স্টুডেন্ট গুলাও ছিল অনেক জোশ!  একবার খেয়াল আছে, ভার্সিটি থেকে সরাসরি আসছি শুনে মেয়েটা তাড়াহুড়ো করে এতোগুলা খাবার নিয়ে আসলো, অথচ মেয়েটা নিজেই সারাদিন কোচিং করে প্রচন্ড টায়ার্ড ছিল! এরকম স্টুডেন্ট পড়ানোও শান্তি। 
একসাথে দুজনকে পড়াতাম, ওরা ছিল রিলেটিভ।গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় এস.এস.সি'র আগে পড়তে আসে দুইমাস।  এতো কেয়ারিং ছিলো ওরা।আমার মিষ্টি পছন্দ প্রথমদিন শুনেই মনে রাখে । প্রায়ই মিষ্টি জাতীয় নাশতা দিতো এবং মনে করিয়ে দিত আমার পছন্দের জন্যই এতোকিছু করা।ইভেন নিউ ইয়ারে আমাকে সুন্দর একটা উপহার ও দেয় ওরা। এতো ভালোবাসা পাবার মতো ভালো পড়ানো আমি কখনই পড়াতে পারবো না আমি জানি! 
কিন্তু কিছু ভালো মানুষ এবং ভালো ফ্যামিলির জন্য আমার টিউশনের অভিজ্ঞতা কেনো জানি একটু বেশিই ভালো! 
একবার এক স্টুডেন্ট পড়াতে গিয়ে দেখি ৭ তালা বাসা! লিফট নেই।প্রথমে ভাবলাম কন্টিনিউ করবো না।কিন্তু স্টুডেন্ট কে দেখি বাচ্চা একটা মেয়ে এবং যাকে দেখলেই সাত তালায় উঠার কষ্ট ভুলে যাবার মতো!  তাই আর না করিনি। 
ভার্সিটি থেকে টিউশনে যেতাম,মাঝেমধ্যে দুপুরের দিকে যাওয়া হতো স্টুডেন্টের বাসায়। লাঞ্চ টাইম কিছুটা ওড টাইম বলে আমি কিছুটা বিব্রত বোধ করতাম। কিন্তু আমার স্টুডেন্টদের ফ্যামিলিগুলা এতো ভালো যে আমি যার বাসায়ই যাইনা কেনো দুপুরের দিকে, মাস্ট লাঞ্চ করাবে! আমি বাসায় থাকি, বাসায় গিয়ে খাবো এই কথা হাজারবার বললেও কেউ শুনতে চাইতোনা। বরং লাঞ্চ করাতোই। একবার পড়ানো শেষ করে চলে যাচ্ছি বাসার গেটের কাছে, আন্টি জোর করে ধরে নিয়ে ভিতরে নিয়ে বললেন, "বাসায় মেহমান আইসক্রিম নিয়ে আসছে, এটা খেয়ে যাও!"
নতুন নতুন আইটেম রান্না করে নাশতা দেয়ার অভ্যাস ছিলো আরেক আন্টির। মনে হতো যেনো নিজেরই বাসা। স্টুডেন্টদের ছোট ভাইবোনদের কথাও বলতে হয়!  নিচের গেইটে নামার সময় যখন সিঁড়ি বেড়ে আমার সাথে নামতো, রাজ্যের গল্প জুড়ে দিতো বাচ্চাগুলা! 
আমার ক্লাস ফাইভে পড়ুয়া এক স্টুডেন্ট ছিলো, সে আবার এক ধাপ এগিয়ে! আমি কোথায় ঘুরতে যাই, আমার লাইফস্টাইল সবকিছুর প্রতি ছিলো তার ভীষণ ইন্টারেস্ট। স্কুলে স্কুলে নাকি ফ্যান্টাসি কিংডমের ৫০% ছাড়ের কুপন দেয়। আমরা ব্যাচ থেকে যেতে চাই এটা শুনে মেয়েটা আমাকে ১৬ টা কুপন ম্যানেজ করে দেয়।আফটার অল, আমার স্টুডেন্ট - আমার মতোই হবে!
ওদের বাসাটা একটু ভিন্নরকম সুন্দর ছিল সেটা বলায় তার আবদার " ম্যাম আসেন, আপনার ছবি তুলে দেই! "
ঝড় বৃষ্টির রাতে একবার আটকে পড়লাম  ওদের বাসায়!!  ছোটো মানুষ, কি সুন্দর করে রুপকথার বই এনে দিয়ে বললো -" ম্যাম, আসেন পড়ি!"
আমি কখনই খুব সিরিয়াস প্রফেশনাল টাইপ টিচার হতে চাইনি। সময়ের ব্যাপারে আমার নিজস্ব মতামত ছিল যতোক্ষণ প্রয়োজন ততোক্ষণই। অনেকদিন আমার ব্যস্ততার জন্য হয়তো কম সময় দিয়েছি, কিন্তু পরেরদিনই সময় পেলে তুমুল গল্প করেছি! 
একটানা একগাদা একঘেয়েমি টাইপ পড়ানো আমার কখনই ভাল্লাগতো না।আমি প্রচুর গল্প করতাম একইসাথে গল্প শুনতামও বটে। স্টুডেন্টদের ভার্সিটির গল্প বলতাম, ওদের বয়সের সময়টুকুর গল্প করতাম।আর স্টুডেন্টরা ওদের স্কুল-কলেজের গল্প শেয়ার করতো। এভাবেই আমাদের মধ্যে ভালো আন্ডার্স্ট্যান্ডিং হয়ে যায়।একটা জিনিস আমার মাথায় সবসময়ই থাকে কোনো কিছু পজিটিভলি বলতে পারলে বা নিতে পারলে তার ফলাফলটা অবশই  বহুগুণে ভালো হয়!!আমি কখনই তাদের পড়ার প্রেশার দিতে চাইনি।পড়তে ভালো লাগলে নিজে থেকেই শিখে রাখবে এমন কায়দা কাজেও লাগে বেশ কয়েকবার।
সে যাই হউক, দিনশেষে আমি এটাই বলবো - ছুটির দিনগুলোয় বাসায় অলসভাবে বসে থাকা মেয়েটি কিংবা সারাদিন ক্লাস শেষে ক্লান্ত মেয়েটি যখনই কোনো স্টুডেন্টের বাসায় যায় গার্ডিয়ানেরা নিজের আপন মেয়ের মতো করে, স্টুডেন্ট ও স্টুডেন্টের ছোটো ভাই-বোনেরা নিজের আপন বড়-আপুর মতো করে যে ভালোবাসা আমাকে দিয়েছেন তাতে আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ। এতোটা ভালোবাসা পাবার মতো কিছুই আমি করতে পারিনি।বিনিময়ে অজস্র ভালোবাসা পেয়েই গেলাম!
সবার টিউশন অভিজ্ঞতা সুখকর হউক, এই  প্রত্যাশা!



No comments:

Post a Comment