বিদায়বেলা
ঘুম থেকে উঠে মেসেঞ্জারে ঢুকে একটা মেসেজ দেখে খুব অবাক হলাম। নিরবের মেসেজ। প্রায় এক বছর পর নিরবের টেক্সট পেয়ে কেমন যেনো এক অদ্ভুত অনুভূতি হলো। রিপ্লাই দিতে গিয়ে অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত রাখলাম। না, একদমই রাগা যাবে না। নিজেকে বুঝালাম।
নিরবঃ হাই দিয়া! কি অবস্থা তোমার?
আমিঃ এইতো আছি।তোমার কি খবর?
নিরবঃ আচ্ছা শোনো, একটা কথা ছিল..
আমিঃ হ্যাঁ, বলো
এরপরই হঠাৎ অফলাইন হয়ে গেলো নিরব। কি বলবে সেটা নিয়ে ভাবতে লাগলাম। সময় যেনো এই মুহূর্তটাতে একদমই কাটতে চায়না। একেকটা মুহূর্তকে মনে হয় একেকটা বছর। এক বছর আগের দিনগুলো মাথায় চলে আসলো নিজের অজান্তে। অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও দেখা করেছিলাম দুজন। অনেকক্ষণ গল্পও করেছিলাম। সবকিছুই স্বাভাবিক ছিলো। হঠাৎ করে কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি আমি। ইন ফ্যাক্ট এখনও বুঝিনা আসলে কেন নিরব এমন করলো!
সেদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার প্রায় পরপরই নিরবের টেক্সট আসলো - " দিয়া, আমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করো না। ভালো থেকো। আর কিছু বলার নেই।বাই"
এই মেসেজটা, হ্যাঁ এই মেসেজটা আমার সকল অনুভূতিকে ভোঁতা করে দেয়। আমার রাগ হওয়া উচিত, কষ্ট পাওয়া উচিত, ঘৃণা করা উচিত।কিন্তু এতো জটিলতায় আমি যেন সবই ভুলে গেলাম। জাস্ট নিজের মনের ভেতর একদম ফাঁকা, একদম শূন্য মনে হলো! এ কেমন অনুভূতি! আমার জানা নেই।
সম্পর্কটা ছিলো এক মাসের মতো। হয়তো বেশ কম,আসলেই কম। কিন্তু এটাই যে আমার প্রথম ও একমাত্র প্রেম।তাই এর ব্যাপ্তি একদমই কম না আমার কাছে। ও খুব ছটফটে ছিলো। কোনো কিছু নিয়ে কথা শুরু করলেই বলতো, বাদ দেও, এটা না ওটা, ইত্যাদি ইত্যাদি। ওর যেটা বেশি ভাল্লাগতো আমার সেটা হলো ওর অবাক হওয়ার পর মুখভঙ্গিটা! আমার এটা মনে আছে, সেটা করে দিছি দেখে ও কি পরিমাণ অবাক হতো। ও জানলে হয়তো আরও অবাক হতো যে শুধুমাত্র ওকে অবাক করার জন্য আমি কতো চিন্তা, কতো লক্ষ্য করি ওকে! কিন্তু নিরব যে আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে সেই ব্যাপারটাই লক্ষ্য করা হলো না, তাই নিরব নয়, অবাক হতে হলো আমাকেই।
আমাকে সবকিছু থেকেই ব্লক করে দেয় নিরব। যোগাযোগের কোনো পথই রাখেনা। আমি ওর জন্য ফেইক আইডি খুলে স্টক করা শুরু করি।সব ঠিকই আছে দেখতে থাকি! ওর ফ্রেন্ডদের থেকে শুনেছিলাম ও নাকি খুব ব্যস্ত। সবার সাথেই যোগাযোগ কমিয়ে দেয়।ওর দেখা পাওয়া যায় না বললেই চলে। এভাবেই চলতে থাকে কিছুদিন।
হঠাৎ একদিন নিরবকে দেখি রিকশায় একটা মেয়ের সাথে যাচ্ছে। তখনই যা বুঝার বুঝে যাই আমি। ব্যস্ততা নামক অজুহাতটি ছিলো তার নতুন বান্ধবীকে নেয়া ব্যস্ততা। নিরবকে ভুলে যাবার চেষ্টা করতে থাকি আমি। ফেইক আইডি ডিলিট করে দেই। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করি আমি।ওর মতো তো আর হতে পারবো না বা হতে চাইও না হয়তো।
হঠাৎ মেসেঞ্জার থেকে টিং করে নোটিফিকেশন আসায় সৎবিৎ ফিরে ফেলাম। ফোন কাঁপার সাথে সাথে হার্টবিট ও যেনো বেড়ে গেলো। রাগ, ভয়, চাপা কষ্টসহ হৃদয়ের সব অনুভূতি নিয়ে মেসেজ পড়া শুরু করলাম! নিরবের মেসেজ! আমার নিরব।
-তোমার সাথে একদিন দেখা করতে চাই।তোমার একটু সময় হবে কি?
- আচ্ছা হবে।
- কাল ফ্রি আছো কি?
- বিকালে পারবা? টিএসসিতে? ৪ টার পর ফ্রি আমি।
- আচ্ছা পারবো।কাল দেখা হবে, বাই।
কথা শেষ হওয়া মাত্রই মাথায় হাজারো চিন্তা জেঁকে বসে। এতোদিন পর হঠাৎ বা কেন নক দিলো ও। আমি তো ভুলতেই চেয়েছিলাম। ভুলেও হয়তো গেছি। থাক, ওর কথা আর ভাববো না।কালই সব প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইবো।কেনো এসেছিলো আমার জীবনে, কেনই বা চলে গেলো,কেনো আবার নক দিলো। ধ্যেত, এতো কেনো আর ভাল্লাগেনা।
ঠিক চারটায় টিএসসিতে গেলাম। গিয়ে দেখি নিরব বসে আছে। ঠিক সে জায়গায়, যেখানে ও আর আমি একসাথে অনেক সময় কাটিয়েছিলাম। আমাদের অনেক সুন্দর স্মৃতির সাক্ষী যেনো জায়গাটা!
- হাই নিরব!
- হ্যালো!
- কখন আসছো তুমি?
- মাত্রই বলতে পারো! চা খাবা?
- হ্যাঁ চলো! মাল্টা চা খাবা নাকি মরিচ চা?
- তোমার এখনও মনে আছে! বাহ বাহ
- ভুলে যাবো কেনো! আজব।
চা খেতে খেতে অনেক গল্প হলো আমাদের। ভালোই যাচ্ছে দিনকাল ওর। আমি পুরনো অভ্যাসসমেত আগের মতোই খেয়াল করলাম নিরবকে। আগের মতোই আছে।চুলের কাট চেঞ্জ করছে।অনেক সুন্দর লাগছে ওকে! আগেও সুন্দর ছিলো। এখন কেনো জানি বেশিই সুন্দর লাগছে!
কোথায় যেনো শুনেছিলাম কেউ এক্স হয়ে গেলে সে অনেক সুন্দর হয়ে যায়।ব্যাপারটা আসলেই সত্যি হয়তো! ব্যাপারটা জীবনের সাথে এমনভাবে মিলে যাবে ভাবিনি কখনও।
নিরব বলতে শুরু করলো তার কথা।
- "শোনা দিয়া, তুমি হয়তো ভাবছো এতোদিন পর আমি কেনো তোমাকে ডাকলাম। আসলে আমি সামনের মাসে চলে যাচ্ছি ইতালি। তুমি জানো আমার মামা ইতালি থাকেন।সেখানেই যাচ্ছি।আর হয়তো দেখা হবে না আমাদের। তাই বিদায় নিতে আসা। তোমার কিছু বলার থাকলে বলো, তারপর আমি বলবো।"
এক নিঃস্বাসে কথাগুলো বললো নিরব। এবার আমার পালা
-" ইতালি চলে যাচ্ছো? আচ্ছা, এ কয়দিন কেমন ছিলা জানতে চাই না। কিন্তু আমার সাথে এমন কেনো করলা? অন্য কাউকে তোমার ভালো লাগে এ কথা জাস্ট আমাকে বললেই হতো। মিথ্যে ব্যস্ততার অজুহাত দিয়ে সরে যাবার মানে কি! ও মিথ্যে কেনো হবে! নতুন বান্ধবীকে নিয়ে তো ঠিকই বিজি ছিলা তুমি! "
- " নতুন বান্ধবী! কার কথা বলছো তুমি? সে আসলো কোত্থেকে? "
- " তোমাকে দেখছিলাম শান্তিনগরে একদিন। রিকশায়। পাশে খুব সুন্দর একটা আপুর হাত ধরে বসেছিলে।"
- " দিয়া! তুমি কার কথা বলছো আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা। মালিবাগ আমার ফুপির বাসা।সেখানে আমার এক ফুফাতো বোন আছে নিতু। ও খুব পিচ্চি, ক্লাস সেভেনে পড়ে! ওর সাথেই হয়তো ছিলাম। বাট হাত ধরা! কি দেখছো তুমি কে জানে!"
- " তাহলে কেনো এসেছিলে, কেনোই বা চলে গেলে!"
- " তোমাকে আমার ভালো লাগতো! অনেক ভালো লাগতো। তাই হুট করে সম্পর্কটা হয়ে গেলো। কিন্তু নিজের প্রচন্ড অনিশ্চয়তা ঘেরা জীবনে তোমাকে আর জড়াতে চাইনি।কোনো ভাবেই না।"
মুখ ফসকে প্রায় বলেই ফেলছিলাম, " ভালো লাগতো বলছো কেন? এখনও কি আর লাগে না!" অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিলাম। ওর সাথে শেষ দেখা। একটুও সিনক্রিয়েট করা যাবেনা, একবিন্দু কষ্ট দেয়া যাবে না!
চা খেলাম, পানি-পুড়ি খেলাম। একসাথে আবার সমাজবিজ্ঞান চত্বরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলাম। বিদায় নেবার সময় আইসক্রিমও খেলাম। ও চলে যাবার সময় শুধু বললাম -"ভালো থেকো"...
বলতে পারলাম না প্রচন্ড মিস করি তোমাকে। আমি সব সময়ই থাকবো তোমার ফিরে আসার প্রতীক্ষায়! সব সময়!
কিছুই বলা হলো না।কারণ সব কথা বলা হয়না।
অসাধারণ!!! লেখনী... লেখালেখি টা চালিয়ে গেলে পাঠক সমাজ খুব খুশী হত। keep it up
ReplyDelete